আত্মহত্যা করছেন গাজাফেরত অনেক ইসরায়েলি সেনা, ‘আমি কী দেখে এসেছি, কেউ বুঝবে না’

 সিএনএন



চার সন্তানের বাবা এলিরান মিজরাহি। ইসরায়েলের একজন সেনাসদস্য ছিলেন। গত বছর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় লড়াই করতে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধ এখনো চলছে। এরই মাঝে গাজা থেকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা হয় আহত এলিরানকে। তবে তত দিনে একজন ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে এলিরান যা দেখেছিলেন, তাতে মানসিকভাবে বড় আঘাত পান। সেখান থেকে ফেরার পর চরম অবসাদে ভুগছিলেন। এর ফল মোটেও ভালো হয়নি। পুনরায় গাজায় পাঠানোর আগে আত্মহত্যা করেন তিনি। এলিরানের মা জেনি মিজরাহি বলেন, ‘সে গাজা ছেড়েছিল, তবে গাজা তাকে ছাড়েনি। সেই অবসাদেই আমার ছেলে মারা গেল।’

এলিরান যে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় তাঁর একটি নাম রয়েছে। একে বলা হয়, ‘পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ (পিটিএসডি)। গাজা থেকে ফেরার পর ইসরায়েলের হাজার হাজার সেনা পিটিএসডিসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে তাঁদের কতজন আত্মহত্যা করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।

গাজা যুদ্ধের সময় যত গড়িয়েছে, ততই আকাশচুম্বী হয়েছে লাশের সংখ্যা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলায় নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন। এরপর থেকে ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় তছনছ হয়েছে পুরো গাজা। সেখানে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে আবার লেবাননে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।

সেনাবাহিনীর কারণে, এই যুদ্ধের কারণে, আমার ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। সে হয় যুদ্ধে গুলিতে বা আরপিজির (রকেট প্রপেলড গ্রেনেড) আঘাতে মারা যায়নি, তবে অদৃশ্য এক গুলি তার জীবন কেড়ে নিয়েছে।
শির, যুদ্ধ থেকে ফিরে আত্মহত্যা করা এলিরান মিজরাহির বোন

গাজায় চার মাস ছিলেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন চিকিৎসক। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সিএনএনকে বলেন, গাজার পর এখন অনেক সেনাকে লেবাননে পাঠানো হতে পারে—এই ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। ইসরায়েলি বাহিনীর বহু সেনাসদস্য এখন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকারকে বিশ্বাস করেন না।

গাজায় সচরাচর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয় না ইসরায়েল সরকার। যাঁরা এ সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁদেরও ইসরায়েলি বাহিনীর পাহারা ও নজরদারির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। ফলে ইসরায়েলের হামলায় গাজার ফিলিস্তিনিদের কতটা দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে বা সেখানে ইসরায়েলি সেনারা কেমন অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছেন, সে চিত্রটা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাজায় লড়াই করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে তাঁরা যে ভয়াবহতা দেখেছেন, তা বাইরের মানুষ সত্যিকার অর্থে কল্পনাও করতে পারবেন না। এই বক্তব্য থেকে উপত্যকাটিতে চলমান নৃশংসতা সম্পর্কে একটা আঁচ পাওয়া যায়। সমালোচকদের ভাষায়—নেতানিয়াহু এই নৃশংসতার নাম দিয়েছেন ‘চিরকালের যুদ্ধ’।

‘আমি যে কী দেখে এসেছি, তা কেউ বুঝবে না’

এলিরানকে গাজায় মোতায়েন করা হয়েছিল গত বছরের ৮ অক্টোবর। তাঁর কাজ ছিল ডি–৯ মডেলের একটি বুলডোজার চালানো। ৬২ হাজার কেজি ওজনের এই যানটি গুলি ও বোমা হামলার মুখেও টিকে থাকতে পারে। হামাসের হামলার পর নিজ আগ্রহে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এলিরান। এর আগে তিনি কাজ করতেন দেশটির একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে।

গাজায় ১৮৬ দিন ছিলেন এলিরান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বুলডোজারে হামলা চালানো হয়। এতে হাঁটুতে আঘাত পান তিনি। তারপর চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে। এপ্রিলে তাঁকে পিটিএসডির চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহেই থেরাপি নিচ্ছিলেন। তবে এই চিকিৎসা তাঁর জীবনে কোনো কাজে আসেনি।

খেতে পারেন না মাংস, রক্ত দেখলে ভয়

গুই জাকেন। এলিরানের এই বন্ধু গাজায় তাঁর সঙ্গে বুলডোজার চালাতেন। তিনি এখন মাংস খেতে পারেন না। খাওয়ার সময় গাজায় বুলডোজারের ভেতর থেকে দেখা নানা দৃশ্যের কথা তাঁর মনে পড়ে। ঘুমাতে গেলে একপ্রকার সংগ্রাম করতে হয়। কারণ, তাঁর কানে সব সময় বাজে বিস্ফোরণের শব্দ।

গাজায় যেসব মরদেহ দেখেছেন, সেগুলোকে এখন ‘মাংসের’ মতো মনে হয় গুই জাকেনের কাছে। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন বুলডোজারের বাইরে তাঁদের (ফিলিস্তিনি) ও আমাদের (ইসরায়েলি সেনা) প্রচুর রক্ত ও মাংস পড়ে থাকতে দেখবেন, তখন তা সত্যিকার অর্থে আপনার খাবারের ওপর প্রভাব ফেলবে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ